KOFIPOST

KOFIPOST

প্রডাক্টিভিটি বাড়ানোর ১০টি কার্যকর উপায়, কম সময়ে বেশি কাজ করার টিপস

মোঃ মাসুদ রানা
মোঃ মাসুদ রানা

প্রকাশঃ ১১ জুলাই, ২০২৫, ১১:৫৭ পিএম

অ+
অ-
প্রডাক্টিভিটি বাড়ানোর ১০টি কার্যকর উপায়, কম সময়ে বেশি কাজ করার টিপস
ছবি ক্রেডিটঃ ভিসার

আজকের ব্যস্ত জীবনে সময়ের অভাব ও কাজের চাপের কারণে অনেকেই নিজের সর্বোচ্চটা দিতে পারেন না। সময় কম, কাজ বেশি, এই সমস্যার কার্যকর সমাধান হতে পারে প্রোডাক্টিভিটি বা উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানো।


এখন আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে, সারাদিন কাজ করলেই কি তা প্রোডাক্টিভিটি? উত্তর হলো না, একটানা কাজ করে যাওয়া মানেই প্রোডাক্টিভ হওয়া নয়। প্রোডাক্টিভিটি মানে হলো সময়কে সবচেয়ে কার্যকরভাবে কাজে লাগানো। আপনি কত কম সময়ে কত বেশি ও মানসম্মত কাজ করতে পারছেন, সেটিই প্রকৃত প্রোডাক্টিভিটির মাপকাঠি। একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে, “ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।” মূলত এই কথাটিই প্রোডাক্টিভিটির মূল দর্শনকে তুলে ধরে।


আপনি যদি কম সময়ে বেশি কাজ করতে চান এবং মান ধরে রেখে সময় বাঁচাতে চান, তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য। চলুন জেনে নিই প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানোর ১০টি সহজ কিন্তু কার্যকর উপায়।


১. সারাদিনের কাজের তালিকা তৈরি করুন

প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে পরদিনের টু-ডু লিস্ট তৈরি করুন। এতে আপনি পরদিন কী কী করতে হবে তা স্পষ্টভাবে জানবেন এবং মন প্রস্তুত থাকবে। ফলে সময় অপচয় না হয়ে কাজগুলো মনোযোগসহকারে ও সুচারুভাবে শেষ করতে পারবেন। মনের মধ্যে দায়িত্ববোধ ও চাপ তৈরি হওয়ায় আপনি কাজ করতে অনুপ্রাণিত হবেন।


২. কাজ অনুযায়ী সময় ভাগ করুন

প্রোডাক্টিভিটি বাড়াতে প্রতিটি কাজ করার জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা একটি কার্যকরী পদ্ধতি। কোনো একটা কাজ আপনি কত সময়ের মধ্যে শেষ করবেন তা নির্ধারণ করে আপনার কাজের সময়কে ভাগ করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে কাজের ধরন অনুযায়ী সময় ভাগ করে নেওয়ার চেষ্টা করুন। এতে করে আপনি কোন কাজে কতটুকু সময় লাগছে তা ট্র্যাক করতে পারবেন। এই ট্রিকটি ফলো করলে আপনার কাজের জন্য একটা মোটিভেশন তৈরি করবে এবং এই মোটিভেশনই কর্মক্ষেত্রে আপনার প্রোডাক্টিভিটি বাড়াবে।


৩. পোমোডোরো টেকনিক ব্যবহার করুন

পোমোডোরো টেকনিক হচ্ছে একটি সময় ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, যা ২৫ মিনিট কাজ শেষে ৫ মিনিটের বিরতির নেওয়াকে বোঝায়। আর এই টেকনিক আপনার প্রোডাক্টিভিটি বাড়াতে সহায়তা করবে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুযায়ী, একজন মানুষ একটানা প্রায় ২৫-৪০ মিনিট পর্যন্ত কোনো একটি বিষয়ে মনোযোগী থাকতে পারে। এরপর তার মনোযোগ কমে যেতে শুরু করে এবং সে তখন অন্য কিছু করতে চায়। এই বিষয়টিকে বলা হয় “ফোকাস ডেডলাইন”। একটা কাজ লম্বা সময় ধরে করলে, শেষের দিকে আপনার প্রোডাক্টিভিটি কমতে থাকবে। তাই কর্মক্ষেত্রে প্রোডাক্টিভ থাকতে হলে কাজের মধ্যে নিয়মিত বিরতি নেওয়া জরুরি। কোনো কাজ করার মধ্যে প্রতি ২০-৩০ মিনিট পর পর ৫ থেকে ১০ মিনিটের বিরতি নিলে তা মনোযোগের ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। তবে হ্যাঁ, অতিরিক্ত বিরতি নেওয়া যাবে না কারণ তাতে করে কাজের জায়গায় আপনার প্রতি সহকর্মীদের বিরূপ মনোভাব তৈরি হবে।


৪. মাল্টিটাস্কিং কে না বলুন

প্রোডাক্টিভ হতে হলে প্রথমেই মাল্টিটাস্কিং বন্ধ করুন। একসাথে অনেক কাজ করতে গেলে আমাদের মস্তিষ্ক ঠিকভাবে ফোকাস করতে পারে না, ফলে কোনো কাজই মানসম্পন্ন হয় না। মাল্টিটাস্কিংয়ে সময় অপচয় হয় এবং প্রতিটি কাজ শেষ করতে বেশি সময় লাগে। তাই একসময় যেসব কাজ করার কথা ছিল, তার অর্ধেকও শেষ হয় না। কাজেই একটি কাজ শেষ করে তবেই পরেরটিতে হাত দিন—এটাই প্রোডাক্টিভ থাকার সহজ উপায়।


৫. অপ্রয়োজনীয় ডিভাইস বা অ্যাপ বন্ধ রাখুন

আমরা অনেক সময় ভাবি, একটু ফেসবুক দেখি, নোটিফিকেশনটা দেখি— তাতে কী এমন হবে? কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই "একটু দেখা" থেকেই আমাদের মনোযোগ ভেঙে যায়। ধরুন আপনি মনোযোগ দিয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন, এমন সময় হঠাৎ ফোনে একটা ইনবক্স এল বা ইনস্টাগ্রাম থেকে একটা রিলসের নোটিফিকেশন। আপনি সেটা খুলে দেখলেন, তারপর আরও একটা, এরপর আরেকটা— এইভাবে আপনি হয়তো ১৫–২০ মিনিট হারিয়ে ফেললেন, যার হিসাবই থাকলো না।


এই ধরনের ডিভাইস, অ্যাপ বা নোটিফিকেশন আমাদের মস্তিষ্ককে এক জায়গায় স্থির থাকতে দেয় না। একবার মনোযোগ নষ্ট হলে সেটাকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতেও সময় লাগে। ফলে আপনি যেই কাজটা ৩০ মিনিটে শেষ করতে পারতেন, সেটা হয়তো এক ঘণ্টারও বেশি সময় নিচ্ছে।


তাই কাজের সময় চেষ্টা করুন মোবাইল ফোন সাইলেন্ট রাখা, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপগুলো লগআউট করে রাখা বা ডু নট ডিস্টার্ব মোড চালু করে রাখা। এমন ছোট ছোট পরিবর্তন আপনাকে অনেক বেশি ফোকাসড করে তুলবে এবং আপনার কাজের গতি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবে। আপনি নিজেই টের পাবেন, সময় বাঁচছে, কাজও এগোচ্ছে—মনও ভালো থাকছে।


৬. শরীরচর্চা ও ঘুম নিশ্চিত করুন

আপনি যতই পরিকল্পনা করুন, প্রোডাক্টিভ হতে চাইলে শরীর ও মনের সুস্থতা ছাড়া সেটি সম্ভব নয়। কারণ একটি ক্লান্ত, অলস বা ঘুম-ঘুম মাথা কোনো কাজেই ঠিকভাবে মন দিতে পারে না। গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুমের অভাবে শুধু মনোযোগই কমে না, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, সৃজনশীলতা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতাও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়।


প্রতিদিন অন্তত ৭ ঘণ্টা গভীর ও নিরবচ্ছিন্ন ঘুম আপনার মস্তিষ্ককে তরতাজা রাখে এবং পরের দিন কাজের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তোলে। শুধু ঘুম নয়, সঙ্গে দরকার নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম। প্রতিদিন অন্তত ২০–৩০ মিনিট হাঁটা, দৌড়ানো, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ বা যে কোনো হালকা ফিজিক্যাল অ্যাকটিভিটি আপনার রক্তসঞ্চালন বাড়িয়ে শরীরকে চাঙ্গা রাখে এবং মন ভালো করে।


বেশি সময় বসে কাজ করলে মাঝে মাঝে উঠে হাঁটুন, স্ট্রেচ করুন। এতে ক্লান্তি কমবে, মনোযোগ বাড়বে এবং আপনি কাজেও আরও বেশি ফলপ্রসূ হবেন। মনে রাখবেন, সুস্থ শরীরই প্রোডাক্টিভ মাইন্ডের মূল চাবিকাঠি। তাই ঘুম ও ব্যায়ামকে গুরুত্ব দিন—এই দুই অভ্যাস আপনার প্রতিদিনের কাজের গুণগত মান অনেকগুণ বাড়িয়ে তুলবে।


৭. শুরুতেই ডেস্ক বা কাজের পরিবেশ গুছিয়ে নিন

আপনি কি কখনো লক্ষ্য করেছেন— কখনো কাজ করতে বসে চারপাশে জিনিসপত্র এলোমেলো থাকলে মনটা অস্থির লাগে? ডেস্কে কাপড়, বই, কাগজ, মোবাইল, কফির কাপ সব গুলিয়ে থাকলে আপনার মনও গুলিয়ে যাবে। কারণ, অগোছালো পরিবেশ আমাদের মনোযোগ ছিন্ন করে দেয় এবং কাজের প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দেয়।


একটা পরিষ্কার, সাজানো ডেস্ক বা নিরিবিলি কাজের জায়গা আপনার মনকে ফোকাসড রাখতে সাহায্য করে। যখন ডেস্কে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় জিনিস থাকবে ল্যাপটপ, খাতা, কলম বা কাজের নোট, তখন আপনার মনও শুধু কাজেই থাকবে। চারপাশের অপ্রয়োজনীয় জিনিস কম থাকলে আপনার মাথার ভেতরেও ‘ক্লাটার’ বা অগোছালো ভাব কমবে।


কাজ শুরুর আগে ৫ মিনিট সময় নিয়ে আপনার কর্মপরিবেশ গুছিয়ে নিন। দরকার হলে হালকা বাতাস চলাচল নিশ্চিত করুন, টেবিলে এক কাপ পানি রাখুন, অপ্রয়োজনীয় নোট বা জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলুন। এভাবে গুছানো পরিবেশ আপনাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করবে এবং কাজের গতি ও মান দুইই বাড়াবে। মনে রাখবেন, গুছানো পরিবেশ মানে গুছানো মন।


৮. প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করুন

আজকের যুগে প্রোডাক্টিভ হতে হলে শুধু পরিশ্রম করলেই হবে না, সঙ্গে থাকতে হবে ‘স্মার্ট ওয়ার্কিং’ এর মানসিকতা। আর সেটা সম্ভব প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার জানলেই। যেভাবে হাতে ঘড়ি দেখে সময় বলা এখন সেকেলে হয়ে গেছে, ঠিক তেমনি খাতা-কলমে টুডু লিস্ট লেখা বা কাজের ট্র্যাক রাখা এখন আরও সহজ ও কার্যকর হয়ে গেছে বিভিন্ন প্রোডাক্টিভিটি অ্যাপের মাধ্যমে।


যেমন ধরুন Trello এটি আপনাকে প্রজেক্ট বা কাজগুলোকে বোর্ড আকারে ভাগ করে পরিকল্পনা ও অগ্রগতি দেখতে সাহায্য করে। Notion একটি অল-ইন-ওয়ান টুল, যেখানে আপনি নোট, ডেইলি প্ল্যান, টাস্ক লিস্ট এমনকি কাজের রেফারেন্সসহ সবকিছু একসাথে রাখতে পারবেন। Google Calendar দিয়ে আপনি কাজের রিমাইন্ডার সেট করতে পারবেন, ডেডলাইন ঠিক রাখতে পারবেন। আর Todoist হলো একটি সহজ টুডু লিস্ট অ্যাপ, যেখানে প্রতিদিনের কাজ লিস্ট আকারে লিখে রাখতে পারবেন এবং সময়মতো তা শেষ করার তাগিদও পাবেন।


এই অ্যাপগুলো আপনার কাজকে সিস্টেমেটিকভাবে সাজাতে সাহায্য করবে, সময় বাঁচাবে এবং ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা কমাবে। ফলে আপনি প্রতিদিন কী করছেন, কী বাকি আছে, কী করতে হবে সবকিছু খুব সহজেই দেখতে পারবেন। প্রযুক্তিকে নিজের সহকারী বানান, যাতে আপনি শুধু কাজ করেন না, দক্ষতার সঙ্গে কাজ শেষও করতে পারেন।


৯. ‘না’ বলতে শিখুন

প্রোডাক্টিভ হতে চাইলে শুধু কাজ করতে জানা নয়, কাজ বাছাই করতেও জানতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, আপনি নিজের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে অন্যের ছোটখাটো অনুরোধে সময় দিয়ে ফেলছেন। কেউ বললো, “ভাই একটু এটা করে দাও”, আরেকজন বললো, “দশ মিনিট সময় দিবে?”—এভাবেই আপনার ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যায়, অথচ নিজের কাজ আটকে থাকে।


সব অনুরোধ রাখা দায়িত্ববোধের পরিচয় নয়। এটা অনেক সময় নিজের ওপর অন্যায় করা হয়ে যায়। কারণ আপনার সময় সীমিত, আর সেই সময় যদি অন্যের অপ্রয়োজনীয় বা সময়সাপেক্ষ অনুরোধে ব্যয় হয়, তাহলে আপনি নিজের টার্গেট পূরণ করতে পারবেন না। তাই সৌজন্য বজায় রেখে ‘না’ বলতে শিখুন।


১০. কাজের রিভিউ করা

প্রোডাক্টিভিটি শুধু কাজ শুরু করার বিষয় নয়, বরং কাজ শেষ হওয়ার পর সেটার মূল্যায়ন করাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই দিন শেষে কী করলেন, কতটুকু সফল হলেন, তা আর ফিরে তাকান না। কিন্তু এই ছোট অভ্যাসটিই আপনার পরবর্তী দিনের কাজকে আরও গোছানো ও কার্যকর করে তুলতে পারে।


প্রতিদিনের শেষে ৫–১০ মিনিট সময় নিয়ে চিন্তা করুন, আজকে আপনি কোন কোন কাজ সফলভাবে শেষ করতে পেরেছেন? কোন কোন কাজ বাকি রয়ে গেছে বা আটকে গেছে? এর পেছনে কারণ কী ছিল? এই মূল্যায়ন আপনাকে বুঝতে সাহায্য করবে কোন জায়গায় সময় অপচয় হয়েছে, কোথায় উন্নতির সুযোগ আছে এবং কীভাবে পরদিন আরও ভালোভাবে কাজ করা যায়।


এভাবে নিজেকে প্রতিদিন যাচাই করলে আপনি ধীরে ধীরে নিজের কাজের ধরন, সময় ব্যবস্থাপনা ও অগ্রগতির উপর স্পষ্ট ধারণা পাবেন। এর ফলে শুধু কাজের গতি বাড়বে না, বরং আপনি নিজের ভুলগুলোও ধরতে পারবেন এবং সেই অনুযায়ী উন্নয়ন ঘটাতে পারবেন।


সুতরাং প্রতিদিন কাজের শেষে নিজেকে প্রশ্ন করুন, "আজ আমি কতটা সফল?" এই অভ্যাসটাই আপনাকে প্রতিদিন একটু করে আরও উন্নত, আরও প্রোডাক্টিভ করে তুলবে।


প্রডাক্টিভিটি বাড়ানো কোনো জাদু নয়, এটা নিয়মিত অভ্যাস, সঠিক পরিকল্পনা এবং সময় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই এটি সম্ভব। আজ থেকেই এই অভ্যাসগুলো শুরু করুন, দেখবেন অল্প সময়ে অনেক কাজ করে ফেলা সম্ভব হচ্ছে।



ট্যাগস:

লাইফ স্টাইলপ্রডাক্টিভিটিমাল্টিটাস্কটিপস

কফিপোস্টের সর্বশেষ খবর পেতে আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল অনুসরণ করুন।

© কফিপোস্ট ডট কম

অনলাইনে পড়তে স্ক্যান করুন