KOFIPOST

KOFIPOST

বিবিসির প্রতিবেদন

তাদের যেখানে পাবে সেখানেই গুলি করবে: গণভবন থেকে শেখ হাসিনা

ডেস্ক রিপোর্ট
ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশঃ ৯ জুলাই, ২০২৫, ৩:৩৪ পিএম

অ+
অ-
তাদের যেখানে পাবে সেখানেই গুলি করবে: গণভবন থেকে শেখ হাসিনা
শিক্ষার্থীদের গুলি করছে পুলিশ - ছবি: সংগৃহীত

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় নিরাপত্তাবাহিনীকে ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের’ নির্দেশ দিয়েছিলেন—সম্প্রতি ফাঁস হওয়া একটি ফোনকলের অডিও থেকে এমনটাই জানা গেছে। ফাঁস হওয়া ওই কলটি হাসিনা তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে করেছিলেন গত বছরের ১৮ জুলাই। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির বিশেষ ইউনিট বিবিসি আই ওই অডিও ভেরিফাই করে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।


ফাঁস হওয়া অডিও কলটিতে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, তিনি নিরাপত্তাবাহিনীগুলোকে আন্দোলনকারীদের ওপর ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের’ নির্দেশ দিচ্ছেন। অডিওতে হাসিনা আরও নির্দেশ দেন, আন্দোলনকারীদের ‘যেখানে পাবে সেখানেই গুলি করবে।’


অডিওটি ইতোমধ্যে ফরেনসিক বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান ‘ইয়ারশট’ পরীক্ষা করে জানিয়েছে, এতে কোনো এডিট বা কারসাজির প্রমাণ নেই। রেকর্ডিংটি ‘প্রামাণ্য’ ও ‘স্বাভাবিক’ বলে বিবেচনা করছে ব্রিটিশ মানবাধিকার সংস্থা এবং জাতিসংঘের তদন্তকারীরাও। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের—যেখানে হাসিনার বিরুদ্ধে বিচারকাজ চলছে— কৌঁসুলিরা তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে এই রেকর্ডিংকে উপস্থাপন করার পরিকল্পনা করছে।


জাতিসংঘের তদন্তকারীদের মতে, গত বছরের আন্দোলনের প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হয়েছে। আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া হাসিনা এবং তার দল তাদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।


আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্রের ভাষ্য, “ওই কলটিতে কোনো বেআইনি উদ্দেশ্য কিংবা অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়ার আলামত নেই।” তবে বিবিসির ভাষ্য অনুযায়ী, অডিওটি এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার নির্দেশনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য দলিল। কথোপকথনটি একজন অজ্ঞাত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে হয়েছিল।


২০২৩ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন দ্রুতই সরকারবিরোধী গণআন্দোলনে রূপ নেয়। ৫ আগস্ট ছিল সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন—সেদিন ঢাকায় গণভবনের দিকে এগিয়ে যাওয়া বিক্ষোভকারীদের আগে থেকেই প্রস্তুত হেলিকপ্টারে চড়ে পালিয়ে যান হাসিনা। একই দিনে যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে অন্তত ৫২ জন নিহত হন বলে বিবিসির তদন্তে উঠে এসেছে—যা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ পুলিশি সহিংসতা। পূর্ববর্তী সরকারি প্রতিবেদনে নিহতের সংখ্যা ছিল ৩০।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, ফাঁস হওয়া ওই কলটি হাসিনা তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে করেছিলেন গত বছরের ১৮ জুলাই। ওই সময় ছিল বিক্ষোভের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। পুলিশের গুলিতে বিক্ষোভকারীদের মৃত্যুর ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। কলটির পরের কয়েক দিনে ঢাকায় সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় এমন রাইফেল সারা ঢাকায় মোতায়েন ও ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিবিসি জানিয়েছেন, বাংলাদেশ পুলিশের একাধিক নথিতে বিষয়টি উঠে এসেছে।


বিবিসি আই ৩৬ দিনের আন্দোলনের শত শত ভিডিও, ছবি এবং সরকারি ও বেসরকারি দলিলপত্র পর্যালোচনা করে দেখেছে, পুলিশের এই দমন-পীড়নে সেনাবাহিনী প্রাথমিকভাবে উপস্থিত থাকলেও পরবর্তীতে তারা সরে গেলে পুলিশ গুলি চালায়। ড্রোন ফুটেজ, সিসিটিভি এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের মোবাইল ভিডিও বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে বিবিসি।


বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) জানিয়েছে ১৮ জুলাইয়ের ওই অডিও রেকর্ডিংটি শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে মেলানো হয়েছে। বিবিসি নিজস্ব তদন্তেও অডিওটি যাচাই করেছে। অডিও ফরেনসিক প্রতিষ্ঠান ইয়ারশট (Earshot) রেকর্ডিংটি পরীক্ষা করে দেখেছে, এতে কোনো এডিট বা কৃত্রিম হস্তক্ষেপের প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং এটি কৃত্রিমভাবে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।


ইয়ারশট জানায়, অডিওটি সম্ভবত এমন একটি কক্ষে রেকর্ড করা হয়েছে, যেখানে ফোনকলটি স্পিকারে চালানো হচ্ছিল। কারণ এতে নির্দিষ্ট ধরনের টেলিফোনিক ফ্রিকোয়েন্সি ও ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড রয়েছে। এতে ইলেকট্রিক নেটওয়ার্ক ফ্রিকোয়েন্সির (ইএনএ) উপস্থিতিও পাওয়া গেছে। কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্রপাতির মধ্যে হস্তক্ষেপ করা হলে এই ইএনএ অডিওতে উপস্থিত থাকে, এবং এটা প্রমাণ করে অডিওটি পরিবর্তন করা হয়নি।


ইয়ারশট হাসিনার কথোপকথনের ধ্বনি, উচ্চারণ, নিশ্বাসের শব্দ এবং স্বর ভঙ্গি বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, রেকর্ডিংয়ে কোনো কৃত্রিম শব্দ নেই। এই বিষয়ে ব্রিটিশ মানবাধিকার আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান বিবিসিকে বলেন, ‘এই রেকর্ডিংগুলো তার ভূমিকা প্রমাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো স্পষ্ট, যথাযথভাবে যাচাই করা হয়েছে এবং অন্যান্য প্রমাণ দ্বারাও সমর্থিত।’ ক্যাডম্যান বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে চলা মামলার পরামর্শক।


আওয়ামী লীগের এক মুখপাত্র নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, ‘বিবিসি যে রেকর্ডিংয়ের কথা বলছে, তা আমরা সত্যতা যাচাই করতে পারছি না।’


বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) নিশ্চিত করেছে, রেকর্ডিংয়ে থাকা কণ্ঠস্বর শেখ হাসিনার সঙ্গে মিলে গেছে। ১৮ জুলাইয়ের পরের কয়েক দিন ঢাকায় সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত রাইফেলের মতো অস্ত্র মোতায়েনেরও প্রমাণ পাওয়া যায়।


আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা ছাড়াও সরকার ও পুলিশের একাধিক সাবেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। মোট ২০৩ জন অভিযুক্তের মধ্যে ৭৩ জন বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।


ঘটনার পর পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকেও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। একজন মুখপাত্র বিবিসিকে জানান, গত বছরের সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৬০ জন পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং কয়েকটি ঘটনায় অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। পুলিশ নিরপেক্ষ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে বলেও তিনি জানান।


আওয়ামী লীগের দাবি, বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগে তাদের নেতারা দায়ী নন। দলের এক মুখপাত্র বলেন, ‘দলের কোনো জ্যেষ্ঠ নেতা, এমনকি শেখ হাসিনা নিজেও ব্যক্তিগতভাবে সহিংসতার নির্দেশ দিয়েছেন বা দায়িত্বে ছিলেন—আওয়ামী লীগ এমন দাবি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করে।’ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মন্তব্য চেয়ে বিবিসি যোগাযোগ করলেও কোনো সাড়া পায়নি।

ট্যাগস:

শেখ হাসিনাজুলাই গণঅভ্যুত্থানজুলাই আন্দোলনঅডিও ফাঁসগণহত্যা

কফিপোস্টের সর্বশেষ খবর পেতে আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল অনুসরণ করুন।

© কফিপোস্ট ডট কম

অনলাইনে পড়তে স্ক্যান করুন