তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি
ইন্টারনেট কী? ইন্টারনেটের সুবিধা গুলো কি কি

মোঃ মাসুদ রানা
প্রকাশঃ ৪ জুলাই ২০২৫, ৭:৩৮ এএম

ইন্টারনেট (Internet) শব্দটি "International Network" থেকে এসেছে, যার অর্থ আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক। এটি হলো বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত অসংখ্য কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সমন্বয়ে গঠিত একটি বিশাল ব্যবস্থা। ইন্টারনেটকে প্রায়শই "নেটওয়ার্কের নেটওয়ার্ক" বা "ইন্টারনেটওয়ার্ক" বলা হয়। সহজ কথায়, এটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নেটওয়ার্কের একটি সমন্বিত রূপ।
ইন্টারনেটকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়: "ইন্টারনেট হলো পৃথিবীজুড়ে বিস্তৃত পরস্পরের সাথে সংযুক্ত অনেকগুলো কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সমষ্টি, যা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত এবং যেখানে IP (Internet Protocol) নামক ব্যবস্থার মাধ্যমে ডেটা আদান-প্রদান করা যায়।" ইন্টারনেটে সংযুক্ত কম্পিউটারগুলোর প্রধান কাজই হলো একে অপরের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করা। এ কারণেই বর্তমানে ডেটা আদান-প্রদান সম্পর্কিত প্রায় সব কাজ ইন্টারনেটের সুবিধার মাধ্যমে হয়ে থাকে। যেমন, ই-মেইলের মাধ্যমে চিঠি আদান-প্রদান, টেলিফোনের আধুনিক সংস্করণ হিসেবে টেলিকনফারেন্সিং বা ভিডিও কনফারেন্সিং ইত্যাদি। ইন্টারনেটের প্রধান উপাদানগুলো হলো এর ব্যবহারকারী, তথ্য, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা এবং কম্পিউটার।
বর্তমানে ইন্টারনেটকে বিশ্বগ্রামের মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর কারণ হলো, ইন্টারনেটের মাধ্যমেই আজ পৃথিবীর সকল মানুষ এক অদৃশ্য জালের মতো নেটওয়ার্ক দ্বারা সংযুক্ত হয়ে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেও ভার্চুয়ালি একে অপরের কাছাকাছি থাকার সুবিধা উপভোগ করছে। ইন্টারনেট এখন আর শুধু টেলিফোন লাইন-নির্ভর নয়, বরং সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে বিস্তৃত অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক, মাইক্রোওয়েভ এবং স্যাটেলাইট কমিউনিকেশনের মাধ্যমে এর বিস্তৃত সক্ষমতা প্রায় অসীম। বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতেই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ইন্টারনেট ওয়ার্ল্ড স্টেটস-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা পৃথিবীর প্রায় ৪ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছিল, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ। ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বিটিআরসি (BTRC)-এর হিসাবমতে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৮০.২৮৯ মিলিয়ন, যার মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাই ছিল সর্বাধিক (৭৫.৩৯৬ মিলিয়ন)।
ইন্টারনেটের ইতিহাস
১৯৬৯ সালে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ARPANET (Advanced Research Project Agency Network) নামক প্রকল্পের মাধ্যমে ইন্টারনেটের যাত্রা শুরু হয়। আরপানেট পরবর্তীতে আশির দশকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সীমিতভাবে উন্মুক্ত ছিল। ১৯৮২ সালে বিভিন্ন কম্পিউটারের মধ্যে নেটওয়ার্ক সংযোগ স্থাপনে উপযোগী TCP/IP (Transmission Control Protocol/Internet Protocol) উদ্ভাবিত হলে প্রথম আধুনিক ইন্টারনেটের ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইন্টারনেটের সুবিধা
ইন্টারনেটের মাধ্যমে যে সকল সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়, সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নিচে উল্লেখ করা হলো:
- তথ্যের বিশাল ভান্ডার: ইন্টারনেট হলো তথ্যের এক বিশাল ভান্ডার। ইন্টারনেটে যুক্ত হয়ে কাঙ্ক্ষিত তথ্যের নাম লিখে সার্চ করলেই বিশ্বের অসংখ্য সার্ভারে থাকা তথ্যগুলো প্রদর্শিত হয়।
- দ্রুত যোগাযোগ: ইন্টারনেটের মাধ্যমে মুহূর্তেই বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে ই-মেইল করে তথ্য আদান-প্রদান করা যায়।
- ফ্যাক্স সুবিধা: ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফ্যাক্স সুবিধাও পাওয়া যায়।
- কম খরচে কথা বলা: VOIP (Voice over Internet Protocol) এর মাধ্যমে প্রচলিত ফোনের চেয়ে খুব কম খরচে বা বিনা খরচে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে কথা বলা যায়।
- বিনোদনের মাধ্যম: ইন্টারনেট টিভি ও ইন্টারনেট রেডিও চালুর ফলে ঘরে বসেই কম্পিউটারে বিভিন্ন ধরনের টেলিভিশন ও রেডিও চ্যানেলের অনুষ্ঠান উপভোগ করা যায়।
- সফটওয়্যার ও বিনোদন সামগ্রী ডাউনলোড: বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার, ফ্রিওয়্যার এবং বিনোদন উপকরণ ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে সংগ্রহ করা যায়।
- অনলাইন সংবাদপত্র: সংবাদপত্র ও সাময়িকীর ইন্টারনেট সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ায় এখন ঘরে বসেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকা পড়া যায়।
- ই-কমার্স: ই-কমার্সের সাহায্যে ঘরে বসেই পণ্য কেনা-বেচা করা যায়।
- দূরশিক্ষণ: ঘরে বসেই বিশ্বের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা গ্রহণ করা যায়।
- ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং: ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, গুগল টক, স্কাইপ ইত্যাদি ইনস্ট্যান্ট মেসেঞ্জার-এর মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে থাকা যেকোনো ব্যক্তির সাথে টেক্সট ও ভিডিও শেয়ার করা যায়।
- অনলাইন চিকিৎসা সেবা: অনলাইনে চিকিৎসা সেবা নেয়া যায়।
- গুগল ম্যাপস: গুগল ম্যাপস এর মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো স্থানের স্যাটেলাইট মানচিত্র দেখে ওই স্থান সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। এসব স্থানের ছবি জুম করে (বড় করে) খুব কাছ থেকেও দেখা যায়।
ইন্টারনেটের সুফল
ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা সুফল পাওয়া যায়:
- শিক্ষার্থীদের জন্য: শিক্ষার্থীরা ক্লাসে উপস্থিত হতে না পারলেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাদের পাঠ্যক্রমের বিষয়ে নানা সহায়তা পেতে পারে। ইন্টারনেট থেকে শিক্ষামূলক বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা ও ব্যাখ্যামূলক তথ্য আহরণ তাদের ফলাফল উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে।
- চাকুরিজীবীদের জন্য: ইন্টারনেট চাকুরিজীবীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, অধিক উপার্জন এবং সময় সাশ্রয়ী সুবিধা প্রদান করে।
- ব্যবসায়ীদের জন্য: ব্যবসায়ে ইন্টারনেটের ব্যবহার বাণিজ্যিক বিপণন, সরবরাহ, প্রচার প্রভৃতি বিষয়কে সাশ্রয়ী ও গতিশীল করে তোলে।
- অর্থনীতিতে প্রভাব: বর্তমানে যেকোনো দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে ইন্টারনেটের ব্যবহার অপরিহার্য।
ইন্টারনেটের কুফল
ইন্টারনেটের যেমন অসংখ্য সুবিধা রয়েছে, তেমনি কিছু কুফলও বিদ্যমান:
- শিক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব: ইন্টারনেটে অনলাইন গেমস, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত সময় ব্যয়, কুরুচিপূর্ণ বিষয়ের চর্চা প্রভৃতি শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মনোযোগ ও সময় নষ্ট করে তাদের ফলাফলে বিপর্যয় ঘটাতে পারে।
- অনলাইন বাণিজ্যে ঝুঁকি: অনলাইনে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পণ্য বা সেবার মান সর্বদা সুনিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে অর্থের অপচয় বা ক্ষতির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি: ইন্টারনেটের মাধ্যমে কম্পিউটারে হ্যাকিং, ভাইরাস বা ম্যালওয়্যার সংক্রমণ, স্প্যামিং প্রভৃতি আক্রমণের ঝুঁকি থাকে।
- ইন্টারনেট আসক্তি: দীর্ঘসময় ইন্টারনেট ব্যবহারে ইন্টারনেট আসক্তি সৃষ্টি হয়। এর ফলে ব্যবহারকারী নানা ধরনের স্বাস্থ্যহানির শিকার হতে পারে এবং মানুষের পারিবারিক জীবনে ব্যাপক দূরত্বের সৃষ্টি হয়।
- ভুয়া তথ্যের বিস্তার: ইন্টারনেটের মাধ্যমে যেকোনো সংবাদ খুব দ্রুত ভাইরাল আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এক্ষেত্রে কোনো ভুয়া বা ভুল সংবাদ ভাইরাল হওয়ার ফলে তা সামাজিক অস্থিরতা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ব্যক্তিগত হয়রানির মতো বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে।
ইন্টারনেট আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এক অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। এর সুবিধা ও অসুবিধা উভয়ই বিবেচনা করে আমাদের এটি সতর্কতার সাথে ব্যবহার করা উচিত।
কফিপোস্টের সর্বশেষ খবর পেতে আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল অনুসরণ করুন।
© কফিপোস্ট ডট কম
অনলাইনে পড়তে স্ক্যান করুন