KOFIPOST

KOFIPOST

বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর আনুষ্ঠানিক ধরনগুলো সংক্ষেপে আলোচনা / ব্যাখ্যা / বিশ্লেষণ / তুলনা কর।

মোঃ মাসুদ রানা
অ+
অ-
বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর আনুষ্ঠানিক ধরনগুলো সংক্ষেপে আলোচনা / ব্যাখ্যা / বিশ্লেষণ / তুলনা কর।
চেয়ারম্যান বা মেম্বার সালিস-মীমাংসা করছে। ছবি: প্রতীকী ছবি

ভূমিকা:

বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর ও গ্রামীণ সমাজভিত্তিক রাষ্ট্র। দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ গ্রামে বসবাস করে। ফলে এখানকার রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রশাসনিক কাঠামোর একটি বড় অংশ গ্রামীণ বাস্তবতার উপর নির্ভরশীল। এই গ্রামীণ সমাজে যে ক্ষমতা কাঠামো বিদ্যমান, তা সাধারণ মানুষ, স্থানীয় প্রশাসন এবং রাষ্ট্রের মধ্যে একটি সংযোগ তৈরি করে। ক্ষমতার এই কাঠামো দুই ভাগে বিভক্ত—আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক। আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা কাঠামো বলতে এমন সকল প্রতিষ্ঠান, পদাধিকারী বা প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়, যা রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত, স্বীকৃত ও পরিচালিত।


গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য:

ক্ষমতা বলতে সাধারণভাবে বোঝানো হয় এমন এক বল বা কর্তৃত্ব, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অন্যের উপর নিজের সিদ্ধান্ত আরোপ করতে পারে। গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো বলতে বোঝায়—সেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, যাদের মাধ্যমে গ্রামীণ সমাজে শাসন, বিচার, সম্পদ বণ্টন ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ কাঠামোর মূল বৈশিষ্ট্য হলো—স্থানীয় জনগণের উপর প্রভাব, প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি, এবং রাষ্ট্রীয় সম্পৃক্ততা।


আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা কাঠামোর ধরনসমূহ:

১. ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ:

গ্রামীণ প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর হলো ইউনিয়ন পরিষদ। এটি দেশের সর্বনিম্ন পর্যায়ের নির্বাচিত সরকারী প্রতিষ্ঠান। একেকটি ইউনিয়ন পরিষদে একজন চেয়ারম্যান ও সাধারণ ওয়ার্ডের জন্য ৯ জন সদস্য এবং সংরক্ষিত নারী আসনের ৩ জন সদস্য থাকেন।

এদের মূল দায়িত্ব হলো—গ্রামীণ উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সালিস-মীমাংসা, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, সরকারি সহায়তা বিতরণ, এবং স্থানীয় সমস্যার সমাধান করা।

এদের জনপ্রিয়তা, রাজনৈতিক পরিচয়, কিংবা প্রশাসনিক দক্ষতা—সব মিলিয়ে তারা গ্রামীণ সমাজে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে থাকেন।


২. পুলিশ প্রশাসন (থানার ওসি):

গ্রামীণ আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থায় পুলিশ প্রশাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ আনুষ্ঠানিক শক্তি। থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) একটি এলাকার নিরাপত্তা, অপরাধ দমন এবং শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন।

প্রভাবশালী ব্যক্তিরা থানার সাথে সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করেন, কারণ অনেক সামাজিক ও রাজনৈতিক বিরোধে থানার ভূমিকা নির্ধারণমূলক হয়। অনেক সময় পুলিশ প্রশাসন রাজনৈতিক প্রভাবেও কাজ করে, যা ক্ষমতা কাঠামোকে আরও জটিল করে তোলে।


৩. তহশিলদার ও ভূমি প্রশাসন:

ভূমি সংক্রান্ত যাবতীয় সরকারি কাজ, যেমন—জমির খাজনা আদায়, খতিয়ান প্রস্তুত, নামজারি ও মিউটেশন—এসব কাজ তহশিল অফিসের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।

তহশিলদার বা সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (এ.সি. ল্যান্ড) এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। গ্রামীণ সমাজে জমিজমার বিরোধ অন্যতম বড় সমস্যা। তাই তহশিলদারদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা, তাদের মাধ্যমে কাজ করানো, কিংবা তাদের প্রভাবিত করা—এই সবই একটি প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার অংশ হয়ে উঠেছে।


৪. সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ও কর্মকর্তাবৃন্দ:

পল্লী উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি (ভিজিডি, ভিজিএফ, বয়স্ক ভাতা ইত্যাদি), কৃষি সহায়তা, রাস্তা নির্মাণ, টিউবওয়েল স্থাপন—এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নের পেছনে স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এখানে ইউপি সদস্য, স্থানীয় কৃষি অফিসার, সমাজসেবা কর্মকর্তা, প্রকৌশলী ইত্যাদিরা আনুষ্ঠানিক ক্ষমতার অংশ।


৫. স্থানীয় নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক প্রভাব:

গ্রামীণ সমাজে যেসব প্রতিনিধি নির্বাচন হন, তাদের পেছনে রাজনৈতিক দল ও দলীয় নেতাদের বড় ভূমিকা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়ই ক্ষমতার মূল উৎস হয়ে দাঁড়ায়। ফলে নির্বাচন একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া হলেও এর পেছনের রাজনৈতিক প্রভাব বিশাল।


বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন:

বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর আনুষ্ঠানিক ধরনগুলো মূলত রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত ও জনপ্রতিনিধিত্বমূলক। এই কাঠামোর মাধ্যমে সরকারের নীতি, উন্নয়ন কার্যক্রম ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রামে বাস্তবায়ন হয়।

তবে বাস্তবে এই কাঠামোতে রয়েছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পৃষ্ঠপোষকতা, দুর্নীতি, এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আধিপত্য। অনেক সময় এই আনুষ্ঠানিক কাঠামো সাধারণ মানুষের পরিবর্তে ক্ষমতাবানদের স্বার্থ রক্ষা করে।


উপসংহার:

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর আনুষ্ঠানিক ধরনগুলো গ্রামীণ শাসন, বিচার ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ইউনিয়ন পরিষদ, পুলিশ, ভূমি প্রশাসন, ও সরকারি কর্মকর্তারা মিলে একটি কাঠামো গড়ে তুলেছেন যা রাষ্ট্রের তৃণমূল পর্যায়ে নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যম। যদিও এই কাঠামোর কার্যকারিতা অনেকাংশে নির্ভর করে ব্যক্তিগত যোগ্যতা, রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতার উপর। সুষ্ঠু, জবাবদিহিমূলক ও জনমুখী কাঠামো গড়ে তুলতে হলে এই আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা কাঠামোর উন্নয়ন, স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করা জরুরি।

ট্যাগস:

ডিগ্রি সাজেশনডিগ্রিরাষ্ট্রবিজ্ঞান

কফিপোস্টের সর্বশেষ খবর পেতে আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল অনুসরণ করুন।

© কফিপোস্ট ডট কম

অনলাইনে পড়তে স্ক্যান করুন