বর্তমান এআই এর যুগেও কেন আপনার এখনও সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করা উচিত

যুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির এই সময়ে চারদিকে কেবল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই নিয়ে আলোচনা চলছে। চ্যাটবট এবং জেনারেটিভ এআই মডেলগুলোর ব্যাপক প্রসারের ফলে অনেকেই ধারণা করছিলেন যে সম্ভবত ঐতিহ্যবাহী সার্চ ইঞ্জিনগুলোর দিন শেষ হয়ে আসছে। সাধারণ মানুষের মনে এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে হাতের মুঠোয় স্মার্ট চ্যাটবট থাকতে কষ্ট করে ওয়েব সার্চ করার প্রয়োজন কী? তবে প্রযুক্তির গভীরে তাকালে দেখা যায় বাস্তবতা আসলে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বর্তমানের জটিল ডিজিটাল পরিবেশে সার্চ ইঞ্জিনগুলো কেবল প্রাসঙ্গিকই নয় বরং তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

সার্চ ইঞ্জিন এবং এআইয়ের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে যা এই প্রশ্নের উত্তর দেয়। এআই মডেলগুলি তাদের প্রশিক্ষণের ডেটাসেটের উপর নির্ভর করে। এই ডেটাসেটগুলি সাধারণত নির্দিষ্ট তারিখের আগে সংগ্রহ করা হয়। ফলস্বরূপ, বর্তমান এবং অত্যাধুনিক তথ্য সম্পর্কে এআই মডেলগুলির কোনো জ্ঞান থাকে না। যখন কোনো ব্যবহারকারী সর্বশেষ খবর, বর্তমান বাজার মূল্য বা আজকের আবহাওয়া সম্পর্কে জানতে চান, তখন একটি সার্চ ইঞ্জিন অবিলম্বে সর্বশেষ তথ্য প্রদান করতে পারে। এআই এর পক্ষে এটি করা সম্ভব নয়।

তথ্যের নির্ভুলতা এবং যাচাইযোগ্যতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এআই মডেলগুলি মাঝে মধ্যে তথ্য ভুল করে বা এমনকি সম্পূর্ণ কল্পনা করে ফেলে, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে হ্যালুসিনেশন বলে পরিচিত। এআই হ্যালুসিনেশন একটি অনন্য সমস্যা, যেখানে মডেলগুলি সত্যিকারের তথ্যের মতো শোনায় এমন কল্পিত বিষয়বস্তু তৈরি করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে অনেক এআই মডেল একাডেমিক উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে চল্লিশ শতাংশের বেশি ত্রুটি প্রদান করে। কিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ কল্পিত রেফারেন্স এবং লেখকদের নাম তৈরি করে দেয় যা কখনো বিদ্যমান ছিল না। এই সমস্যাটি বিশেষভাবে গুরুতর কারণ এআইকে প্রায়শই এর ভুলগুলি গোপন করতে বা ভ্রান্ত নিশ্চয়তার সাথে উপস্থাপন করতে ডিজাইন করা হয়েছে।

অন্যদিকে, সার্চ ইঞ্জিনগুলি সরাসরি উৎস পাতাগুলিতে লিঙ্ক প্রদান করে, যা ব্যবহারকারীদের স্বাধীনভাবে তথ্য যাচাই করতে সাহায্য করে। ব্যবহারকারীরা প্রকৃত উৎস পরীক্ষা করতে পারেন এবং তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন।

এআইয়ের নির্ভুলতা বৃদ্ধির জন্য একটি নতুন কৌশল উদ্ভাবিত হয়েছে যার নাম আরএজি বা রিট্রিভাল অগমেন্টেড জেনারেশন। এই পদ্ধতিতে, এআই মডেল প্রথমে ওয়েব সার্চ করে প্রাসঙ্গিক তথ্য খুঁজে বের করে, তারপর সেই তথ্যগুলি তার প্রশিক্ষণ ডেটার সাথে একত্রিত করে উত্তর তৈরি করে। এই পদ্ধতি এআইয়ের হ্যালুসিনেশন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে এবং আরও নির্ভরযোগ্য ফলাফল প্রদান করে। অনেক আধুনিক এআই প্ল্যাটফর্ম এখন এই আরএজি প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, যা প্রমাণ করে যে সার্চ ইঞ্জিন এবং এআই এর সমন্বয় একসাথে সেরা কাজ করে। কিন্তু আরএজি এর নিজেরও সীমাবদ্ধতা আছে। এটি সম্পূর্ণভাবে হ্যালুসিনেশন দূর করে না কারণ এআই এখনও পুনরুদ্ধার করা তথ্যের চারপাশে ভুল তথ্য যোগ করতে পারে।

বিশেষায়িত এবং নিশ বিষয়গুলিতে সার্চ ইঞ্জিনের শ্রেষ্ঠত্ব আরও স্পষ্ট। কল্পনা করুন যে কেউ একটি বিরল রোগ সম্পর্কে গবেষণা করছেন বা কোনো অস্পৃশ্য বৈজ্ঞানিক কাগজ খুঁজছেন। সার্চ ইঞ্জিনগুলি নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট, একাডেমিক ডাটাবেস এবং বিশেষজ্ঞ ফোরামগুলিতে পৌঁছাতে পারে। এআই মডেলগুলি সাধারণ জ্ঞানের জন্য উত্তম হতে পারে, কিন্তু গভীর, বিশেষায়িত তথ্যের জন্য সার্চ ইঞ্জিনই অপরিহার্য।

ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা এবং ডেটা সুরক্ষা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক যেখানে সার্চ ইঞ্জিনের ভূমিকা নির্ণায়ক। যখন আপনি একটি সার্চ ইঞ্জিনে কোনো প্রশ্ন করেন, তখন সেই তথ্য ব্যবহার করে আপনার একটি বিস্তৃত প্রোফাইল তৈরি করা হতে পারে। তবে অনেক সার্চ ইঞ্জিন এখন গোপনীয়তা সুরক্ষার দিকে নজর দিচ্ছে। বিপরীতে, এআই চ্যাটবটের সাথে কথোপকথন চলমান থাকে এবং সেই সংলাপগুলি কোম্পানির সার্ভারে সংরক্ষিত থাকে, যা গোপনীয়তা ঝুঁকি বাড়ায়।

এআই এবং সার্চ ইঞ্জিনের মধ্যে সবচেয়ে স্মার্ট পদ্ধতি হলো এদুটিকে একসাথে ব্যবহার করা। অনেক আধুনিক এআই প্ল্যাটফর্ম এখন রিয়েল-টাইম ওয়েব সার্চ ক্ষমতা সংহত করছে। এর মানে ব্যবহারকারীরা এআইয়ের কথোপকথনমূলক ক্ষমতা এবং সার্চ ইঞ্জিনের বর্তমান তথ্য অ্যাক্সেসের সুবিধা উভয়ই পাচ্ছেন। এই সমন্বয় প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নির্দেশ করে।

ভবিষ্যতের ডিজিটাল ল্যান্ডস্কেপ খুব সম্ভবত এআই এবং সার্চ ইঞ্জিনের সহযোগিতামূলক মডেলের দিকে এগিয়ে যাবে। সার্চ ইঞ্জিনগুলি ক্রমাগত তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে এবং এআই প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করছে, যখন এআই সিস্টেমগুলি রিয়েল-টাইম ওয়েব ডেটা অ্যাক্সেসের জন্য সার্চ ইঞ্জিনের দিকে ফিরছে। এই সিনার্জি ব্যবহারকারীদের জন্য আরও শক্তিশালী এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহের সরঞ্জাম তৈরি করছে। বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে আগামী বছরগুলিতে এআই এবং সার্চ ইঞ্জিনের একীভূত সিস্টেমগুলি আরও বেশি জনপ্রিয় হবে, যেখানে ব্যবহারকারীরা এআইয়ের কথ্য ক্ষমতা এবং সার্চ ইঞ্জিনের তথ্য যাচাইয়ের সুবিধা উভয়ই পাবেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি জগতে এআই এবং সার্চ ইঞ্জিন একে অপরের প্রতিপক্ষ না হয়ে বরং পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। ইতিমধ্যেই অনেক প্ল্যাটফর্ম এই দুই প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাতে শুরু করেছে। ব্যবহারকারীরা এআইয়ের মাধ্যমে সহজ ভাষায় উত্তর পাওয়ার পাশাপাশি সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে তথ্যের উৎস যাচাই করার সুবিধাও পাচ্ছেন। এই যৌথ ব্যবস্থাপনাই আগামী দিনে তথ্য প্রযুক্তির মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে। সংক্ষেপে বলা যায় এআই আমাদের কাজ সহজ করে দিলেও তথ্যের নির্ভুলতা ও গভীরতার জন্য সার্চ ইঞ্জিন আজও অপরিহার্য।