ই-কমার্স বলতে কী বুঝায় এবং এর সুবিধা ও অসুবিধা

ভূমিকা

আধুনিক ব্যবসায়ের জগতে ই-কমার্স একটি বিপ্লবী পরিবর্তন এনেছে। ইন্টারনেটের বিস্তৃতি এবং প্রযুক্তির অগ্রগতি মানুষের কেনাকাটার ধরন সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। আজকাল ঘরে বসে একটি মোবাইল বা কম্পিউটারের মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে পণ্য কিনতে পারা সম্ভব হয়েছে ই-কমার্সের কল্যাণে। এই প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসায় পদ্ধতি শুধু ক্রেতাদের জন্য নয়, ব্যবসায়ীদের জন্যও সুযোগের নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে।

ই-কমার্স কী

ইলেকট্রনিক কমার্সকে সংক্ষেপে ই-কমার্স বলা হয়। এটি এমন একটি ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া যেখানে ইন্টারনেট বা কম্পিউটার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পণ্য বা সেবার ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন হয়। শুধু কেনাবেচাই নয়, বরং পণ্যের মার্কেটিং, ডেলিভারি, সার্ভিসিং এবং অনলাইনে মূল্য পরিশোধের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া ই-কমার্সের আওতায় পড়ে। ১৯৬০ সালে ইলেকট্রনিক ডেটা ইন্টারচেঞ্জের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হলেও ১৯৯৫ সালে অ্যামাজন ও ই-বে এর আবির্ভাবের পর ই-কমার্স নতুন মাত্রা পায়। বর্তমানে মোবাইল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসারে এই খাত আরও শক্তিশালী হয়েছে।

অনলাইন শপিং ধারণা

অনলাইন শপিং হলো ই-কমার্সের একটি জনপ্রিয় রূপ। ১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডের মাইকেল অল্ডরিচ এই পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এর মাধ্যমে ক্রেতারা ঘরে বসে পণ্য পছন্দ ও ক্রয় করতে পারেন এবং নিরাপদে মূল্য পরিশোধ করতে পারেন। এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো শারীরিক পরিশ্রম ও সময় সাশ্রয়। ক্রেতাকে বাজারে যেতে হয় না এবং অর্থ বহনে কোনো ঝুঁকি নেই। তথ্য প্রযুক্তির এই সুবিধা ব্যবসায়ের আধুনিক পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত এবং এটি বিশ্বগ্রামের একটি অন্যতম সুফল হিসেবে গণ্য করা হয়।

মোবাইল কমার্স

মোবাইল কমার্স হলো তারবিহীন প্রযুক্তির মাধ্যমে যেকোনো স্থান থেকে ই-কমার্স সেবা গ্রহণের ব্যবস্থা। মোবাইলের মাধ্যমে টাকা স্থানান্তর, মোবাইল ব্যাংকিং, মোবাইল এটিএম এবং মোবাইল টিকেটিং এই পদ্ধতির আওতায় পড়ে। স্মার্টফোনের ব্যাপক প্রচলনের ফলে মোবাইল কমার্স এখন ই-কমার্সের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার

ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার হলো কম্পিউটারভিত্তিক সিস্টেমের মাধ্যমে এক বা একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অর্থ স্থানান্তরের প্রক্রিয়া। এটি ই-কমার্সের মূল ভিত্তি। ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ, ইলেকট্রনিক চেক এবং ওয়েবসাইট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে অর্থ বিনিময় এই পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত। এই ব্যবস্থা অর্থ লেনদেনকে দ্রুত, নিরাপদ এবং সহজ করে তুলেছে।

বারকোড এবং কিউআর কোড

বারকোড হলো মেশিনে তৈরি সাংকেতিক কোড যা পণ্যের তথ্য সংরক্ষণ করে। পণ্যের গায়ে থাকা কালো দাগের সমষ্টি একটি বিশেষ যন্ত্র দিয়ে স্কান করলে কম্পিউটারে পণ্যের নাম ও মূল্য প্রদর্শিত হয়। এটি হিসাবে ভুল কমায় এবং লেনদেন দ্রুততর করে। কিউআর কোড হলো এক ধরনের ত্রিমাত্রিক বারকোড। এতে মেসেজ, ওয়েবসাইটের ইউআরএল, ফোন নম্বর ইত্যাদি তথ্য ছবির আকারে এনকোড করা থাকে। সাদা পটভূমিতে বর্গাকৃতি কালো বিন্দুর সমন্বয়ে তৈরি এই কোড যেকোনো ক্যামেরা দিয়ে পড়া যায়। আধুনিক ই-কমার্সে এই প্রযুক্তি পেমেন্ট ও তথ্য আদান-প্রদানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

ই-কমার্সের সুবিধা

ই-কমার্স ব্যবসায় ও ভোক্তা উভয়ের জন্য অসংখ্য সুবিধা নিয়ে এসেছে। এই পদ্ধতির মূল সুবিধাগুলো হলো:

• দ্রুত ক্রয় ও বিক্রয় প্রক্রিয়া এবং সহজে পণ্য খুঁজে পাওয়া যায়

• ব্যবসায় পরিচালনায় খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমায়

• ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে সহজেই ক্রেতার কাছে পৌঁছানো যায়

• পণ্যের গুণগত মান উন্নয়নে সহায়তা করে

• কম খরচে উন্নতমানের সেবা প্রদান করা সম্ভব হয়

• বাহ্যিক দোকান বা সেটআপ ছাড়াই ব্যবসা পরিচালনা করা যায়

• সহজেই ব্যবসা শুরু এবং ব্যবস্থাপনা করা যায়

• ক্রেতা শারীরিকভাবে না গিয়ে ঘরে বসে পণ্য নির্বাচন করতে পারেন

ই-কমার্সের অসুবিধা

সুবিধার পাশাপাশি ই-কমার্সের কিছু অসুবিধাও রয়েছে যা ব্যবসায়ীদের মোকাবিলা করতে হয়

• দক্ষ জনবলের যথেষ্ট অভাব রয়েছে

• উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রে ব্যয়বহুল

• মাত্রাতিরিক্ত অর্ডার সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে

• দূরবর্তী স্থানের অর্ডার ক্ষেত্রবিশেষে অনেক ব্যয়বহুল

• আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগে নানা জটিলতা রয়েছে

• লেনদেনের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়

উপসংহার

ই-কমার্স বর্তমান যুগের ব্যবসায়ে এক অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে এর পরিধি আরও বিস্তৃত হচ্ছে। যদিও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবুও সুবিধার পাল্লা অনেক ভারী। ভবিষ্যতে আরও উন্নত প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে ই-কমার্স আরও শক্তিশালী হবে এবং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হবে। তাই ই-কমার্সকে শুধু একটি ব্যবসায়িক মাধ্যম নয়, বরং আধুনিক জীবনযাত্রার একটি প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে দেখা উচিত।