বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান চিত্র ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ


শিক্ষা হলো একটি দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। একটি জাতির উন্নতির মূল ভিত্তিই হলো শিক্ষিত জনগণ। বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে নানা ধরনের উন্নয়ন— মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, কারিগরি ও অনলাইন শিক্ষা গুরুত্ব পাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ-সুবিধাও আগের চেয়ে বেশি। তবে পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও আছে— শিক্ষার মান, অবকাঠামোর দুর্বলতা, বৈষম্য, ও আধুনিক শিক্ষার ঘাটতি।
এই আর্টিকেলে আমরা জানব, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিবাচক অগ্রগতি, বর্তমান সমস্যাগুলো, এবং ভবিষ্যতে যেসব বিষয়ে কাজ করতে হবে, সেগুলোর বাস্তবচিত্র।
বর্তমান চিত্র
বাংলাদেশের শিক্ষা নিয়ে অনেক কথাই হয়— কখনো প্রশংসা, কখনো অভিযোগ। তবে যদি বাস্তবভাবে বলি, তাহলে মেনে নিতেই হবে যে গত ২০ বছরে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখন শিশুদের ভর্তি প্রায় ৯৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। মেয়েরা এখন আগের চেয়ে বেশি স্কুলে যাচ্ছে। এমনকি তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারও এখন অনেক বেড়েছে, যা আগে কল্পনাও করা যেত না।
- মূল কিছু অগ্রগতি
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক বড় পরিবর্তন এসেছে। শুধু শহরেই না, গ্রামগঞ্জেও এখন শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে মেয়েদের অংশগ্রহণ, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষার প্রসার, অনলাইন শিক্ষার বিকাশ এবং উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের সুযোগ— সব মিলিয়ে আজকের শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্র অনেকটাই আশাব্যঞ্জক।
- মেয়েদের অংশগ্রহণ
আগে অনেক পরিবারেই মেয়েদের স্কুলে পাঠানো নিয়ে দ্বিধা ছিল। কিন্তু এখন সেই চিত্র পাল্টে গেছে। গ্রামের অনেক স্কুলে দেখা যায়, মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের চেয়েও বেশি। মেয়েরা শুধু স্কুলে যাচ্ছে না, ভালো ফলাফলও করছে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যন্ত মেয়েদের সফলতা আমাদের সমাজে বড় একটা পরিবর্তনের বার্তা দেয়। এই পরিবর্তন শুধু শিক্ষার না, মানসিকতারও। এখন অনেক বাবা-মা বিশ্বাস করেন, মেয়েরাও ছেলেদের মতো সমাজে অবদান রাখতে পারে— শুধু সুযোগটা দিতে হয়।
- কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব
আগে আমাদের শিক্ষা মানেই ছিল ‘সাধারণ শিক্ষা’। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন সরকার কারিগরি শিক্ষার দিকেও বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। হাতে-কলমে শেখা এই শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীরা খুব সহজেই পেশাজীবনে প্রবেশ করতে পারছে। শুধু তাই নয়, মাদরাসা শিক্ষাকেও এখন আধুনিক করা হচ্ছে— ইংরেজি, গণিত, কম্পিউটার এসব বিষয়ও শেখানো হচ্ছে। ফলে ধর্মীয় জ্ঞান ছাড়াও জীবনব্যবস্থার জন্য দরকারি দক্ষতা নিয়েও এগিয়ে যেতে পারছে শিক্ষার্থীরা।
- অনলাইন শিক্ষার বিকাশ
করোনাকালে যখন সব স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে গেল, তখন অনলাইন শিক্ষা অনেকটাই আশার আলো দেখায়। অনেক শিক্ষক নিজ উদ্যোগে ফেসবুক লাইভে ক্লাস নিয়েছেন। “শিখন”, “ক্লাসটিউব” বা ইউটিউব এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাসায় বসেই পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে। হয়তো সেই সময় সবকিছু নিখুঁত ছিল না, কিন্তু এটা প্রমাণ করে দিয়েছে— প্রযুক্তি থাকলে শিক্ষাকে থামিয়ে রাখা যায় না। এখন অনেক স্কুল-কলেজেই মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু হয়েছে, শিক্ষকরা ভিডিও কনটেন্ট বানাচ্ছেন। শিক্ষার পদ্ধতিতেই একটা পরিবর্তন আসছে।
- উচ্চশিক্ষার প্রসার
আগে অনেকেই উচ্চশিক্ষা নিতে পারত না কারণ সুযোগ ছিল সীমিত। কিন্তু এখন শুধু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও বেড়েছে। ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলায় প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি গড়ে উঠেছে। অনেকে এখন ঘর থেকে দূরে না গিয়েও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে। পাশাপাশি অনলাইন কোর্স, ভার্চুয়াল ক্লাস, স্কলারশিপের সুযোগ— সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি বিকল্প পাচ্ছে।
বিদ্যমান সমস্যা ও দুর্বলতা
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় গত এক দশকে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে— তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এটাও ঠিক, সব কিছু ঠিকঠাক চলছে এমনটা বললে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হবে। এখনো এমন কিছু সমস্যার মুখোমুখি আমরা, যেগুলো সমাধান না হলে এই অগ্রগতি খুব বেশি দূর এগোতে পারবে না।
- শিক্ষার মানগত দুর্বলতা
শিক্ষা শুধু সার্টিফিকেট অর্জনের বিষয় নয়— এটা একজন মানুষের চিন্তা-ভাবনার বিকাশ ঘটায়। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা একটু ভিন্ন। অনেক শিক্ষক এখনো যথাযথ প্রশিক্ষণ পাননি। পাঠদানের পদ্ধতিও এখনো অনেক জায়গায় একঘেয়ে, মুখস্থনির্ভর। এতে করে শিশুরা প্রশ্ন করতে শেখে না, কৌতূহল হারিয়ে ফেলে। শুধু বইয়ের লাইনের পর লাইন মুখস্থ করলেই যেন পরীক্ষায় ভালো ফলাফল আসবে— এই ধারণা থেকে আমরা এখনো বের হতে পারেনি।
- কোচিং আর জিপিএ নির্ভর শিক্ষা
বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে— কে কত ভালো জিপিএ পেল। জ্ঞান অর্জনের চেয়ে নম্বর পাওয়ার প্রতিযোগিতাই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এই কারণে অভিভাবকরাও স্কুলের পাশাপাশি কোচিং-সেন্টারে ছেলেমেয়েকে পাঠাতে বাধ্য হন। এটা একটা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী দিনশেষে ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়ে— কিন্তু সত্যিকারের শেখা কতটা হলো, সেটা প্রশ্নই থেকে যায়।
- অবকাঠামোগত সমস্যা
শহরের স্কুলগুলো কিছুটা আধুনিক হলেও, গ্রামে এখনো অনেক স্কুল আছে যেখানে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা নেই। অনেক স্কুলে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ নেই, নেই আলাদা টয়লেট, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা কিংবা বিদ্যুৎ। বর্ষাকালে ছাদ চোঁয়ায়, টেবিল-চেয়ার ভাঙা— এই বাস্তবতাই প্রতিদিনের বিষয়। এমন পরিবেশে ছাত্রছাত্রীরা ঠিকভাবে ক্লাস করবে কীভাবে?
- কারিগরি শিক্ষার অবমূল্যায়ন
বর্তমান সময়ের চাহিদা অনুযায়ী সবচেয়ে দরকারি শিক্ষা হলো— কারিগরি শিক্ষা। কিন্তু এখনো অনেকেই মনে করেন, যারা "ভালো ছাত্র" না, তারাই টেকনিক্যাল স্কুলে পড়ে। অথচ বাস্তবে এই শিক্ষাই একজনকে দ্রুত কর্মজীবনে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। বিদেশে কাজ করার ক্ষেত্রেও দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষার গুরুত্ব অনেক বেশি। কিন্তু এই মানসিকতা না বদলালে অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ দক্ষতার দিক থেকে পিছিয়ে পড়বে।
- গবেষণার ঘাটতি
বিশ্ববিদ্যালয় মানেই গবেষণার কেন্দ্র। কিন্তু আমাদের অধিকাংশ পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার তেমন কোন পরিবেশ নেই। গবেষণার জন্য তহবিল, সুযোগ, সময়— কোনোটাই পর্যাপ্ত নয়। তাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই। অথচ দেশকে এগিয়ে নিতে নতুন আবিষ্কার, নতুন চিন্তা, এবং উদ্ভাবন জরুরি— যা গবেষণার মাধ্যমেই সম্ভব।
ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
“আধুনিক” বা “স্মার্ট বাংলাদেশ” গড়ার স্বপ্ন আমরা অনেকেই দেখি। কিন্তু শুধু স্কুলে শিশুদের ভর্তি করিয়ে বা কিছু ভবন বানিয়ে দিলে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে না। আসল কাজ হলো— মানসম্মত ও সময়োপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করা। আগামী প্রজন্মকে শুধু পরীক্ষায় পাস করানো নয়, গড়ে তুলতে হবে চিন্তাশীল, দক্ষ ও সৃজনশীল মানুষ হিসেবে। আর তা সম্ভব কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের মাধ্যমেই।
১. শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও আনন্দদায়ক ও প্রভাবশালী করতে হলে গুণগত মানে পরিবর্তন আনতেই হবে। এর জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। শিক্ষকদের শুধু বই পড়ানো নয়, ছাত্রদের কিভাবে চিন্তা করতে শেখাবেন— তা শিখানো দরকার। ক্লাসে বইয়ের পাশাপাশি গল্প, ভিডিও, প্রশ্নোত্তর, দলগত কাজ— এসবের ব্যবহার বাড়াতে হবে। শিশু যেন ভয় না পায়, বরং আগ্রহ নিয়ে ক্লাসে অংশ নেয়— এমন পরিবেশ তৈরি করাই হবে মানসম্মত শিক্ষার প্রথম ধাপ।
২. কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষার বিস্তার
আগামী পৃথিবী হবে প্রযুক্তিনির্ভর। তাই এখন থেকেই এআই (আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্ট), রোবটিক্স, সফট স্কিল (যেমন—যোগাযোগ দক্ষতা, দলগত কাজ), প্রোগ্রামিং এসব শেখানোর আয়োজন করতে হবে। স্কুল স্তর থেকেই শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শিখতে দেওয়া উচিত। কারিগরি শিক্ষাকে শুধু "টেকনিক্যাল স্কুল"-এর ভেতরে সীমাবদ্ধ না রেখে, সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেও মিশিয়ে দেওয়া দরকার। এতে তারা বাস্তব জীবনের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠবে।
৩. শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি
বর্তমানে জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মাত্র ২ শতাংশের নিচে— যা খুবই অপ্রতুল। শিক্ষা হলো কোনো দেশের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ। যদি আমরা চাই শিক্ষিত, দক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানের নাগরিক গড়তে, তবে শিক্ষাখাতে বাজেট বাড়াতেই হবে। বেশি বাজেট মানে বেশি স্কুল নয়— মানে মানসম্মত শিক্ষক, আধুনিক ল্যাব, শিক্ষার্থীর জন্য প্রযুক্তি, আর শিক্ষক প্রশিক্ষণের সুযোগ।
৪. প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষায় জোর দেওয়া
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রযুক্তি আমাদের শিক্ষার প্রতিটি স্তরে পৌঁছাতে হবে। অনলাইন ক্লাস, ডিজিটাল কনটেন্ট, ভার্চুয়াল পরীক্ষা, ই-লাইব্রেরি— এসব আর বিলাসিতা নয়, বরং শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া দরকার। প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগুলোতেও যেন অন্তত একটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি।
৫. শহর আর গ্রামের মধ্যে বৈষম্য দূর করা
আমাদের একটা বড় সমস্যা হলো— শহরের ভালো স্কুলগুলো অনেক আধুনিক, আর গ্রামের স্কুলগুলো এখনো পিছিয়ে। ফলাফল, এক দেশের ভেতরে দুই রকম শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে। এটা শুধু অন্যায় নয়, ভবিষ্যতের জন্য বিপদও। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ তখনই সম্ভব, যখন মফস্বলের একটা ছেলেও একই মানের শিক্ষা পাবে, যেমনটা পাচ্ছে শহরের শিক্ষার্থীরা।
সবশেষে
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সত্যিই এক পরিবর্তনের সময় পার করছে। স্কুলে ভর্তি হার বেড়েছে, মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে অনেক জায়গায়— এসব নিঃসন্দেহে আশার কথা। কিন্তু শুধু এই সংখ্যাগুলো দেখেই আত্মতুষ্ট হওয়া যাবে না।
এখনো বহু শিক্ষার্থী মানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। শহর-গ্রামের বৈষম্য, কারিগরি শিক্ষার গুরুত্বহীনতা, গবেষণার অভাব— এসব সমস্যা থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন তখনই সফল হবে, যখন প্রতিটি শিশুর হাতে থাকবে মানসম্মত ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা। যে শিক্ষা তাকে শুধু পাস করাবে না, বরং মানুষ হতে সাহায্য করবে— ভাবতে, প্রশ্ন করতে, নতুন কিছু তৈরি করতে শেখাবে। এখন সময় দেখানোর আমরা শুধু শিক্ষার সংখ্যা বাড়াতে চাই না, আমরা সত্যিকারের শিক্ষা দিতে চাই। যে শিক্ষা সমাজ বদলায়, ভবিষ্যৎ গড়ে তোলে।
কফিপোস্টের সর্বশেষ খবর পেতে আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল অনুসরণ করুন।
© কফিপোস্ট ডট কম
অনলাইনে পড়তে স্ক্যান করুন